ভারত মহাসাগরের দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশির মাঝে প্রায় ১২০০ এর মত দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দেশের নাম মালদ্বীপ। পরম করুনাময়ের অশেষ রহমতে ভয়ংকর সুন্দর এই দেশ ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
মালদ্বীপ অর্থ দ্বীপের মালা। গুগল ম্যাপ খুলে মালদ্বীপ খুজলে আসলেই দ্বীপের মালার মতই মনে হয় একে। এখানে রয়েছে ২৬ টি এটোল আর ১১৯২টি ক্ষুদ্র দ্বীপ। এটোল মানে লেগুন ঘেরা প্রবালদ্বীপ। এই ১১৯২ টা দ্বীপের মধ্যে মাত্র ২০০টি বসবাসযোগ্য।
কিছু কিছু দ্বীপকে গড়ে তোলা হয়েছে একেবারে পর্যটন এর জন্য প্রাইভেট আইল্যান্ড হিসেবে। এখানে আছে ওয়াটার ভীলা, বীচ ভিলা ইত্যাদি চোখ জুড়ানো মনোরম কিছু স্থাপনা, যেগুলাতে থাকার জন্য দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে। এমন একটি রিসোর্টে আমরা ছিলাম ৩দিন। ভারত মহাসাগরের কোলে অসম্ভব সুন্দর একটি দ্বীপে রাজকীয় বসবাস বলা যায়। বাইরের দেশের যেমন ইউরোপ আমেরিকার পর্যটক রা তাদের বড়সড় ছুটি কাটাতে এখানে হাজির হন। সমুদ্রের পাশে পেতে রাখা বীচ চেয়ারে একটা বই আর তাজা ফলের জুস অথবা বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে অলস ভাবে দিনের পর দিন কাটায়ে দেয় তারা। মহিলারা সানবাথ করেন কড়া রোদে, রোদে পোড়া শরীর আমাদের জন্য আতংক হলেও তাদের নাকি সেই পোড়া বাদামী রং ভারী পছন্দ। তাদের পিচ্চি পিচ্চি ছোট্ট বাচ্চাগুলাও বিপুল আনন্দ নিয়ে আশেপাশে ঘুড়াঘুড়ি করে, বীচের বালু দিয়ে ক্যাসেল বানায়। ছোটকাল থেকেই তারা শিখে যায়, জীবন টা এমনই, ১১মাস কাজ কর, আর ১মাস ভ্যাকেশন কাটাও। জীবনটাকে উপভোগ কর।
সেই অসম্ভব সুন্দর রিসোর্টের বীচ ভিলা আর ওয়াটার ভিলা তে থেকেছিলাম আমরা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই ভিলার সিড়ি দিয়ে ভারত মহাসাগরের কোলে নেমে গিয়েছিলাম। টলটলা স্বচ্ছ পানিতে রং-বেরংগের মাছ ঘুরে বেরাচ্ছে এর মধ্যে আমরা হাটু ডুবিয়ে দাড়ায়ে আছি, পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে!
সমুদ্রের প্রকান্ড ঢেউ এখানে এসে আঘাত করেনা, কারন অনেক দূরে কোরাল রীফে আছড়ে পরে সেটি, এখানে বীচের কাছাকাছি এসে তৈরী হয় স্বচ্ছ পানির লেগুন, যেখানে সাতার না জেনেও দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যায় কোন ভয়টয় ছাড়াই।
রিসোর্টের বিলাসিতা শেষ করে আমরা ওদের একটি লোকাল কাম ট্যুরিস্টিক আইল্যান্ড এও গিয়েছিলাম, সেখানে হয়ত রিসোর্ট এর অত আরামদায়ক পরিবেশ নেই, কিন্তু প্রকৃতি তার সৌন্দর্য দানে কোন কৃপনতা করেনি সেখানেও। নীল জলরাশি এখানেও একেবারেই একরকম, সেই দ্বীপটির একটা পাশ গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটন মুখী ভাবে, হোটেল রেষ্টুরেন্ট দিয়ে ভর্তি, আরেকপাশে মালদ্বীপ এর প্রকৃত অধিবাসীরা থাকেন। ঘুরতে আসা ইউরোপীয়ানদের জীবনযাত্রা ওদের মোটেও প্রভাবিত করতে পারেনি, মেয়েয়া কি সুন্দর বোরকা পড়ে শান্ত শিষ্ট ভাবে হেটে যাচ্ছে, দোকান চালাচ্ছে, পর্যটকরা যা যা জানতে চাচ্ছে তার উত্তর দিচ্ছে, কিন্তু তাদের লাইফস্টাইল ধারন করার কোন ইচ্ছা তাদের নেই।
সেই দ্বীপেও আমরা ৩দিন কাটিয়েছি, তার তাদের ছোট্ট রাজধানী শহরটাও ঘুরে দেখেছি ২দিন মিলে। তাদের জনসংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। তাই ওয়ার্কার বা যেকোন কাজেই তারা বাহির থেকে জনবল নিয়ে আসে। প্রচুর বাংলাদেশী কাজ করে সেখানে, শহরের হোটেল, রেষ্টুরেন্ট গুলা বলতে গেলে তারাই চালায়। তারপরেও ট্যাক্সিতে এবং বিভিন্ন দোকানে অনেক মালদিভিয়ান দের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাদের কে আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম তোমরা কোথা থেকে এসেছ? সিটিতেই জন্ম নাকি বিভিন্ন আইল্যান্ড এ। বেশীর ভাগ ই উত্তর দিত তাদের জন্ম যেখানে হয়েছে সেই আইল্যান্ড এখান থেকে অনেক দূরে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করতাম তোমাদের কোন লাইফ ভাল লাগে? এখন যেখানে আছ এই সিটি লাইফ নাকি আইল্যান্ড লাইফ?
এই প্রশ্ন শুনলেই ওদের চোখ চকচক করে উঠত, বলত
‘অবশ্যই আইল্যান্ড লাইফ, আইল্যান্ড লাইফ যে কি সুন্দর তোমরা ত জাননা, তোমরা যাও সুন্দর করে বানানো রিসোর্টে, যেগুলা বানিয়েছে বাইরের দেশের লোকজনরা এসে, আমাদের আইল্যান্ড গুলা অসম্ভব সুন্দর, আমরা চাইলেই আশেপাশের যেকোন আইল্যান্ডে গিয়েও ঘর বাধতে পারি, আমাদের জমি কিনতে হয়না। সারাদিন আমরা সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতাম, সাতার কাটতাম, নৌকা চালাতাম, অসম্ভব এডভেঞ্চারাস একটা লাইফ ছিল আমাদের, রাতের বেলা আগুন জালায়ে আমরা মাছ পুড়ায়ে খেতাম, তারপর সবাই মিলে গান গাইতাম।
এখন হয়ত অনেক কিছু চিন্তা করে সিটিতে থাকি, সিটিতেও আমাদের সরকার আমাদের থাকার জন্য ঘর বাড়ি দিয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস কর, এখনো আমার মনে হয় আবারো আইল্যান্ড লাইফে ফিরে যাই’
আইল্যান্ড লাইফ বলার সময় লোকটার চোখের সেই স্বপ্নীল ভাবটা এখনো মনে পরে আমার। আমারো তখন মনে হইছিল, আহারে ইট পাথরের এই বন্দী শহরে না থেকে ঐ ভয়ংকর সুন্দর লাইফটা ত আমারো হতে পারত। কোন জবাবদিহীতা নাই কিছু নাই, শুধু অনন্ত নীল সাগরের জলরাশি।
আহারে! জীবন কতরকম ই না হতে পারে।
~ কোভিড পরবর্তী সময়ে যে কয়টা দেশ সবচেয়ে কম রেস্ট্রিকশনের মধ্যে ট্রাভেলার দের এর জন্য তাদের দরজা খোলা রেখেছে তাদের মধ্যে অন্যতম মালদ্বীপ। গত এক বছরের স্ট্রেসফুল লাইফ শেষে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ভ্রমনপ্রিয় মানুষরা মালদ্বীপ ঘুরে আসতে পারেন খুব সহযেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মালদ্বীপ ভ্রমন এবং টোটাল খরচ নিয়ে একটা ডিটেইল পোষ্ট লেখার ইচ্ছা আছে যদি আপনারা ইন্টারেস্টেড হন।
~ মালদ্বীপ অনেক বেশি এক্সপেন্সিভ এটা সত্য, তবে এটাও ঠিক এক্সপেন্সিভ প্রাইভেট রিসোর্ট বাদ দিয়ে জনপ্রিয় কিছু লোকাল ট্যুরিস্ট আইল্যান্ডকে বেছে নিয়ে আপনি আপনার খরচ অনেক অনেক কমিয়ে আনতে পারেন, এছাড়াও আপনার রিসোর্টের সাইট সিলেকশনের উপরেও কষ্টিং ডিপেন্ড করবে, ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে না গিয়ে আমি সবসময় নিজের প্ল্যান নিজে করে ঘুরতে পছন্দ করি, এবারেও তাই করেছিলাম। কিভাবে কি করতে হবে এব্যাপারেও পরবর্তী পোষ্টে ডিটেইলস লিখার চেস্টা করব ইন শা আল্লাহ।
~ আজকে এখানেই শেষ করি। পৃথিবীটা আবারো ভ্রমনপিপাসু মানুষদের গল্পে ভরে উঠুক, এই প্রত্যাশায়।